

রিয়াদ থেকে প্রতিবেদন:
সৌদি আরবে চলমান বৈধতা পরিদর্শন অভিযানের অংশ হিসেবে গত এক সপ্তাহে দেশজুড়ে প্রায় ২০,০০০ প্রবাসীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও জননিরাপত্তা বিভাগ এক যৌথ বিবৃতিতে এই তথ্য নিশ্চিত করেছে।
এই অভিযানটি সৌদি সরকারের দীর্ঘমেয়াদি ‘ন্যাশনাল ক্যাম্পেইন ফর আইডেন্টিটি অ্যান্ড রেসিডেন্স রেগুলেশনস’ এর অংশ, যার উদ্দেশ্য দেশজুড়ে বসবাসরত অভিবাসীদের বৈধতা যাচাই ও অবৈধ অভিবাসন রোধ করা।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে পরিচালিত অভিযানে মোট ২০,৩৬৫ জন প্রবাসীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ ছিলেন ভিসার মেয়াদোত্তীর্ণ, কাজের অনুমতিপত্র না থাকা, অথবা অবৈধ পথে সীমান্ত অতিক্রমকারী।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র জানান, “প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৩,০০০ অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। এর আওতায় বিভিন্ন শহর, গ্রাম, শিল্প এলাকা, নির্মাণ ক্ষেত্র এবং বাণিজ্যিক অঞ্চলগুলোতে তল্লাশি চালানো হচ্ছে।”
গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে আগত। বিশেষ করে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল এবং ফিলিপাইন থেকে আগত প্রবাসীরা এ ধরনের অভিযানে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
বিভিন্ন সূত্রের দাবি, গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে অনেকেই আগে বৈধ ভিসায় সৌদি আরবে প্রবেশ করলেও পরবর্তীতে তাদের বৈধতা নবায়ন না করায় অথবা চাকরি বদলের কারণে তারা অবৈধ অভিবাসীর তালিকায় পড়ে যান।
গ্রেফতারের পর অভিযুক্তদের যাচাই-বাছাই করে বিচারের আওতায় আনা হচ্ছে। যাদের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে এবং যাদের কেবল নথিপত্র ত্রুটিপূর্ণ, তাদের নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতে, এই অভিবাসন নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের লক্ষ্য শুধুমাত্র অবৈধদের শাস্তি দেওয়া নয়, বরং প্রবাসী নীতিমালার প্রতি সম্মান প্রদর্শন নিশ্চিত করা।
বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের দূতাবাসগুলো তাদের নাগরিকদের উদ্দেশ্যে সচেতনতামূলক প্রচার চালাচ্ছে। তারা প্রবাসীদের বৈধতার কাগজপত্র হালনাগাদ রাখতে, অনুমোদিত কোম্পানির অধীনে কাজ করতে এবং কোনো ধরনের অবৈধ কাজে জড়াতে নিষেধ করছে।
বাংলাদেশ দূতাবাস এক বিবৃতিতে জানায়, “আমরা সৌদি সরকারের নিয়মনীতি মেনে চলতে প্রবাসীদের আহ্বান জানাচ্ছি। কোনো সমস্যা হলে দূতাবাসের হটলাইনে যোগাযোগ করতে অনুরোধ করা হচ্ছে।”
প্রবাসীদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। কেউ কেউ কাজের স্থানে যেতে ভয় পাচ্ছেন, আবার অনেকেই আতঙ্কে নিজ নিজ আবাসে লুকিয়ে আছেন। তবে একইসঙ্গে অনেকে মনে করছেন, এ ধরনের অভিযান নিয়মিত হলে বৈধ প্রবাসীদের জন্য পরিস্থিতি স্বস্তিকর হবে।
একজন প্রবাসী বাংলাদেশি জানান, “আমি বৈধ কাগজপত্র নিয়ে আছি, তবু মনে ভয় লাগে। রাস্তায় চেকপোস্ট দেখলেই দুশ্চিন্তা হয়।”
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো সৌদি আরবের এই ধরপাকড় অভিযান নিয়ে কিছুটা উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তাদের মতে, অভিযান চলাকালীন অনেক ক্ষেত্রে প্রবাসীদের যথাযথ সুযোগ না দিয়েই গ্রেফতার করা হচ্ছে এবং অনেকে হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
তবে সৌদি সরকার এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে, সমস্ত অভিযান আইনের সীমার মধ্যেই পরিচালিত হচ্ছে এবং যেকোনো প্রবাসীর অধিকার যথাযথভাবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সৌদি আরবের এই কঠোর অভিবাসন নীতি তার ‘ভিশন ২০৩০’ পরিকল্পনার অংশ। দেশটি চায় কর্মসংস্থানে স্থানীয় নাগরিকদের বেশি সম্পৃক্ত করতে এবং অবৈধ অভিবাসন বন্ধ করে একটি সুশৃঙ্খল শ্রমবাজার তৈরি করতে।
তবে এর ফলে যেসব দেশ থেকে প্রচুর পরিমাণে শ্রমিক যায়—বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়া—তাদের জন্য এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠছে। প্রবাসী আয় নির্ভর এই দেশগুলোর অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদে প্রভাব ফেলতে পারে।
সৌদি আরবে চলমান বৈধতা অভিযান একটি কঠোর বাস্তবতা সামনে এনেছে। একদিকে এটি আইনের শাসনের প্রতিফলন, অন্যদিকে মানবিক সংকটেরও ইঙ্গিত। প্রবাসীদের উচিত আইন মেনে চলা এবং কাগজপত্র হালনাগাদ রাখা। একইসঙ্গে দূতাবাস ও আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোর উচিত আরও সক্রিয় হয়ে সমস্যা মোকাবেলায় সাহায্য করা।